Tuesday, January 7, 2014

‘সস্তায় শ্রম নয়, বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের দরকার দক্ষ শ্রমশক্তি’

‘সস্তায় শ্রম নয়, বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের দরকার দক্ষ শ্রমশক্তি’

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেছেন, সস্তা শ্রম শুরু থেকে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের চালিকা শ্রক্তি হিসেবে কাজ করেছে। তবে প্রবৃদ্ধি গতিধারা বজায় রাখতে হলে এখন আর শুধু সস্তা শ্রমের ওপর নির্ভর করলে চলবে না। দরকার দক্ষ শ্রমশক্তি। এর প্রতিফলন না ঘটলে এই শিল্প বেশি দিন এগুতে পারবে না।
শনিবার জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে পোশাক শিল্পে চ্যালেঞ্জ এবং উত্তরণের উপায় শীর্ষক জাতীয় সংলাপে তিনি এ কথা বলেন।
গবেষণা সংগঠন চিন্তার চাষ ও দি ঢাকা ফোরাম সংলাপটির যৌথ আয়োজন করে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে সংলাপে উপস্থিত ছিলেন, ঢাকা বিশ্বব্যিালয়ের অধ্যাপক কেএএম সা’দউদ্দিন, ড. এআই মাহবুব উদ্দীন আহমেদ, বিজিএমইএ সাবেক সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদী, বিকেএমইএ’র ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম, বিকেএমইএ সাবেক সভাপতি ফজলুল হক, চিন্তার চাষের চেয়ারম্যান মুহাম্মাদ শফিকুর রহমান, গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতি’র সভাপতি তাসলিমা আক্তার লিমা, শ্রমিক নেতা বাহরানে সুলতান বাহার প্রমুখ।
সংলাপে অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেন, রাজনৈতিক সদিচ্ছা, গভীর গবেষণা, মালিক শ্রমিক দূরত্ব, কার্যকরি ট্রেড ইউনিয়ন ও অবকাঠামোগত সমস্যা পোশাক শিল্পের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এ থেকে উত্তরণ ও শিল্পকে এগিয়ে নিতে শ্রমিক কল্যাণ তহবিল গঠন ও সমস্যা সমাধানের ওপর জোর দেন বক্তারা।
সংলাপে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন, অর্থনৈতিক গবেষণা ব্যুরোর পরিচালক ও ঢাকা বিশ্বব্যিালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. শফিকউজ্জামান।
বিশিষ্ট কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, পোশাক শিল্পকে বাচাতে হলে মালিক শ্রমিক সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটাতে হবে। আর এই শিল্পের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় গবেষণা দরকার; যা করতে বিজিএমইএকে দায়িত্ব নিতে হবে।
বিআইডিএস এর গবেসণা পরিচালক ড. বিনায়ক সেন বলেন, বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে যারা ঢাকার বাইরে কারখানা করবে তাদের জন্য অবকাঠামোগত সুবিধা দিতে হবে। যার পুরো দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে।
 তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা মাহবুব জামিল বলেন, রাজনৈতিকভাবে এখন ট্রেড ইউনিয়ন ব্যবহার হচ্ছে। এ থেকে বেরিয়ে আসলে ট্রেড ইউনিয়ন আরও ভূমিকা রাখতে পারতো। আবার সরকারের অনেক কিছু করার থাকলেও তা করছে না।
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক এম.এম আকাশ বলেন, সরকারের দায়িত্বটা কতটুকু কার্যকরি হবে তা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর পুরোপুরি নির্ভর করে। শ্রমিকদের অধিকার, নিয়মিত মজুরি কিংবা সঠিক ক্ষতিপূরণ দিতে পারছি না আমরা। তোবার শ্রমিকদের বেতন নিয়ে এমন হতো না। যদি এর জন্য কোনো কল্যাণ তহবিল থাকতো।
সিপিডির অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, পোশাক খাতে মালিক শ্রমিক উন্নতি যতটুকু হয়েছে ততটুকু সামাজিকভাবে উন্নতি হয়নি। শ্রমিকদের অতিরিক্ত কাজ ও উৎপাদনশীলতা একরকম নয়। তাদের চাপ দিয়ে ওভারটাইমের কাজ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে করা হচ্ছে বলে মনে করেন তিনি।
মূল প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়, সস্তা শ্রমিকই পোশাক শিল্পের গড়ে ওঠার অন্যতম কারণ ছিল। তবে স্বল্প মজুরি যা চলতি বাজারে টিকে থাকার জন্য যথেষ্ট না হলেও শ্রমিকরা দলে দলে যোগ দিয়েছে এবং এই শিল্পকে এগিয়ে নিয়েছে।
তবে ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি, তার উপর অনিয়মিত বেতন ভাতা এবং কাজের সুষ্ঠু পরিবেশের অভাবের কারণে শ্রমিক অসন্তোষ বাড়ছে।এর চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ হলো নিরাপত্তাহীনতা।একের পর এক অগ্নিকাণ্ড প্রাণহানির ঘটনায় শ্রমিকরা নিরাপত্তা নিয়েই বেশি আতঙ্কিত।
বলা হয়, বিল্ডিং কোড মেনে কারখানা তৈরি করে পোশাক শিল্প শুরু হয়নি। বরং পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়াই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে মালিকরা তড়িঘড়ি করে আবাসিক বাসাবাড়িতে কারখানা স্থাপন করেছে। এটা শুধু পোশাক শিল্পের জন্য ক্ষতি নয় বরং মালিক-শ্রমিক তথা গোটা অর্থনীতির জন্যও ক্ষতি।
শ্রমিককের মজুরি বৃদ্ধির কথা উঠলেই বাজার হারানোর প্রশ্ন আসে।যখন বেতন ৬০০ টাকা ছিল তখনও একই প্রশ্ন বারবার এসেছে। যিনি কম দামে মান সম্পন্ন পণ্য বাজারে ছাড়তে পারবেন তিনিই টিকে থাকবেন।এর জন্য প্রয়োজনীয় উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি।তার জন্য প্রয়োজন উন্নত প্রযুক্তি ও দক্ষ শ্রমিক।কিন্তু শ্রমিকের দক্ষতা বৃদ্ধির কোনো উদ্যোগ নাই।
শিল্পের চ্যালেঞ্জ নিয়ে বলা হয়,তিন দশকের বেশি সময় পার হওয়ার পরও আমাদের পোশাক শিল্প এখনও এ টিকে থাকার সংগ্রামে লিপ্ত। এত দীর্ঘ সময়েও যদি এই শিল্প টিকে থাকার সংগ্রাম করতে হয় তাহলে এখনও উদ্যোক্তারা উদ্যোক্তার বৈশিষ্ট্য অর্জন করতে পারেনি।এখনও নিজস্ব ব্রান্ডের কোনো পণ্য বিশ্ববাজারে পরিচিত করাতে পারেনি। তাই আমাদেরকেও কৌশল পাল্টাতে হবে। শুধু সস্তা শ্রমমূল্যের উপর নির্ভর না করে উৎপাদনশীলতা এবং গুনগত মান বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হবে, সেই সঙ্গে প্রয়োজন পণ্যের বৈচিত্রকরণ এবং বাজারের সম্প্রসারণ।
শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, পণ্যের বৈচিত্রকরণ, উচ্চ মূল্যের পণ্য উৎপাদনের জন্য দক্ষতা বৃদ্ধি ও কাজের পরিবেশ উন্নয়নের বিকল্প নাই।এ লক্ষ্য অর্জন করতে হলে শ্রমিককের বেতন বৃদ্ধি এবং তার নিরাপত্তা ও জীবনের মান উন্নয়নের বিষয়টিও অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে।

No comments:

Post a Comment