Thursday, December 16, 2010

পোশাক ক্রেতাদের নজর এখন বাংলাদেশে : বায়ারদের চাপে অর্ডার নেয়া বন্ধ করে দিয়েছেন অনেকে

পোশাক ক্রেতাদের নজর এখন বাংলাদেশে : বায়ারদের চাপে অর্ডার নেয়া বন্ধ করে দিয়েছেন অনেকে
সৈয়দ মিজানুর রহমান

গত অর্থবছরের প্রথম ৫ মাস জুলাই-নভেম্বরে যেখানে পোশাক রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি (মাইনাস) ছিল, চলতি বছরের একই সময়ে সেখানে রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে সাড়ে ৩৫ শতাংশ। যেসব কারখানা গত বছর রপ্তানি আদেশ না থাকায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, সেগুলোতে এবার কাজের চাপে নতুন অর্ডার নেয়া বন্ধ করেছেন কর্তৃপক্ষ। পোশাক মালিক-শ্রমিকদের ব্যস্তাই শুধু বাড়েনি। রাজধানীর অভিজাত এলাকার বায়িং হাউজগুলোতে দিন-রাত কাজ চলছে। অভিজাত এলাকার হোটে-রেস্টুরেন্টগুলোতে চাপ বেড়েছে বিদেশী ক্রেতাদের ভীড়ে। এসব তথ্য পোশাক রপ্তানিকারকদের।

খোজ নিয়ে জানা গেছে, শুধু তৈরি পোশাকেরই নয়, অন্যান্য পণ্যের রপ্তানির বেলায় একই অবস্থা। গত অক্টোবর থেকেই রপ্তানি খাত ঘুরে দাড়াতে শুরু করে। সংশিস্নষ্টরা মনে করছেন, চলতি অর্থবছর শেষে রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধি অন্তত ৩০ শতাংশের কাছাকাছি থাকবে।

তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ'র দেয়া তথ্য মতে, চলতি ২০১০-২০১১ অর্থবছরের প্রথম ৫ মাসে রপ্তানিতে ইউডি বেড়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ। পোশাক খাতে ইউডি বাড়ার অর্থই হলো রপ্তানি আদেশ বাড়ছে। সংগঠনের সভাপতি আবদুল সালাম মুর্শেদী জানান, বিশ্ব বাজারে চাহিদা অস্বাভাবিক বেড়েছে। তবে যেই হারে অর্ডার আসছে, সবগুলো সেভাবে ধরা যাচ্ছে না। কারণ উলেস্নখ করে তিনি বলেন, ঘনঘন বিদ্যুতের লুডশেডিং, চট্টগ্রাম বন্দরের অব্যবস্থাপনা এবং সময়মত প্রণোদণা প্যাকেজ না পেয়ে অনেক উদ্যোক্তা নতুন করে কাজ শুরু করতে পারছেন না। যেসব প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, সেগুলোর অনেকেই উতপাদন শুরু করেছেন, তবে শতকরা হিসেবে এ সংখ্যা ১৫/২০ ভাগের বেশি হবে না। তিনি জানান, প্রণোদনা প্যাকেজ সময়মত বাস্তবায়ন হলে এখন যেসব প্রতিষ্ঠান বন্ধ বা ঠিকমত উতপাদন করতে পারছে না, সেগুলো পুরো দমে উতপাদনে থাকত। এতে দেশের জন্যই মঙ্গল হত। তবে নতুন নতুন বাজার তৈরি হচ্ছে বেেলা তিনি জানান।

সূত্র মতে, দেশের সবচেয়ে বড় রফতানি আয়ের খাত তৈরি পোশাকশিল্প। এ শিল্পের বাজার প্রতিনিয়তই বাড়ছে। দেশের রফতানি আয়ের প্রায় ৭৮শতাংশই আসে এ খাত থেকে। মূলত বাংলাদেশের তৈরি পোশাক ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি রফতানি হ"েছ। সাড়ে ১২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের এ শিল্পটি বাজার সমপ্রসারণের জন্য নানা উদ্যোগ নিলেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের দূতাবাস অথবা কাউন্সিলিং সেন্টার না থাকায় উদ্যোগগুলো কাজে লাগছে না।

এদিকে পোশাকশিল্পের নতুন বাজার খুঁজতে গিয়ে গত বছর বিজিএমইএ'র একটি প্রতিনিধি দল ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, চিলি, উরুগুয়ে, পতর্ুগালসহ ল্যাটিন আমেরিকার আরো কয়েকটি দেশ ভ্রমণ করে। এ ভ্রমণের ফলাফল হিসেবে সমপ্রতি শেষ হওয়া বটেঙ্পো মেলায় উপরোক্ত দেশগুলোর ক্রেতাদের অংশগ্রহণ এবং এদেশ থেকে পোশাক ক্রয়ের জন্য স্পট অর্ডারও দিয়েছেন।

এবারের বাটেঙ্পো মেলায় মোট ৬৫ মিলিয়র মার্কিন ডলারের স্পট অর্ডার পেয়েছেন এদেশের পোশাকশিল্পের মালিকরা। পাশাপাশি আরো ৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের অর্ডার নিয়ে আলোচনা চলছে। কিন্তুু অর্ডার পেলেও সেসব দেশে বাংলাদেশের দূতাবাস বা কাউন্সিলিং সেন্টার না থাকায় রফতানি কার্যক্রম দ্রুত করা সম্ভব হচ্ছে না।

যেসব দেশে বাংলাদেশের দূতাবাস রয়েছে সেসব দেশে বাণিজ্যিক কর্মকর্তা না থাকায় অনেক সময় রফতানি কার্যক্রম পরিচালনা করতে অনেক সময় লেগে যায়। ফলে বাংলাদেশকে প্রতিবছরই কোন না কোন বায়ার হারাতে হ"েছ। বর্তমানে জাতিসংঘের সদ্যভুক্ত ১৯৩টি দেশের মধ্যে মাত্র ৩৯টি দেশে বাংলাদেশের দূতাবাস অথবা কাউন্সিলিং সেন্টার রয়েছে।

একদিকে নতুন বাজার সমপ্রসারণের মাধ্যমে এ শিল্পকে যতই এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে বিজিএমইএ। সরকারের কূটনৈতিক পর্যায়ের জোর লবিংয়ের অভাবে বিশেষ করে আফ্রিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন দেশে দূতাবাস না থাকার কারণে দেশগুলোতে পোশাক রফতানি করতে পারছেন না রফতানিকারকরা। ল্যাটিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশসহ আফ্রিকার কয়েকটি দেশে এদেশের তৈরি পোশাকের পর্যাপ্ত চাহিদা রয়েছে বলেও জানিয়েছে বিজিএমইএ'র একটি সূত্র।

এশিয়ার অনেক দেশে দূতাবাস থাকলেও বাণিজ্যিক পরামর্শক না থাকার কারণে ব্যবসায়ীদের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করতে পারছেন না অনেক ব্যবসায়ী। চীন, জাপান, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ আরো কয়েকটি দেশেও পোশাক রফতানির অর্ডার পেয়েছেন দেশের ব্যবসায়ীরা। কিন্তুু দ্রুত ভিসা প্রাপ্তি এবং দূতাবাসগুলোতে বাণিজ্যিক লবিস্ট না থাকার কারণে খুব সহজে রফতানি করতে পারেছেন না পোশাকশিল্প মালিকরা।

এ ব্যাপারে বিজিএমইএ সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদী বলেন, নতুন বাজার সমপ্রসারণের মাধ্যমে কয়েক বিলিয়ন মার্কিন ডলার রফতানি আয় করতে পারবে এ দেশ। ফলে দেশের অর্থনীতি আরো মজবুত হবে। এ ব্যাপারে পররাষ্ট্রমন্ত্রী অনেক আশার কথা শুনিয়েছেন কিন্তুু এখনো কার্যকরী কোন পদক্ষেপ গ্রহণ আমাদের চোখে পড়েনি।

তিনি আরো বলেন, আমরা ইতোমধ্যেই ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, চিলিসহ দক্ষিণ আফ্রিকায় বাজার সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তুু এ বাজার ধরে রাখার জন্য এবং সমপ্রসারণের জন্য ব্যবসায়ীদের সেদেশগুলোতে যেতে হয়। কিন্তুু আমারা তা পারছি না।

শুধু তৈরি পোশাকই নয়, জানা গেছে, অন্যান্য পণ্যের রপ্তানি বাড়ছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) সূত্র জানিয়েছে, গত অক্টোবরে রপ্তানি খাতে আয় হয়েছিল ১ হাজার ৬৮৮ দশমিক ২১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। আর নভেম্বরে আয় এসেছে ১ হাজার ৫৫৩ দশমিক ৮৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। অক্টোবরের তুলনায় নভেম্বরে রপ্তানি খাত আয় কিছুটা কমলেও, গত বছরের তুলনায় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৯ দশমিক ৭৬ শতাংশ। অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-অক্টোবর) রপ্টস্নানি খাতে মোট আয় হয়েছে ৮ হাজার ২৭৫ দশমিক ২৯ মিলিয়ন ডলার। যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩৫ দশমিক ৮০ ভাগ বেশি বলে জানিয়েছে রপ্তানি উন্নয়ন বু্যরো (ইপিবি)।

জুলাই-নভেম্বর দু'একটি পণ্য ছাড়া রপ্তানি খাতের অধিকাংশ পণ্য রপ্তানিতেই বড় অঙ্কের প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এ সময়ে তৈরি পোশাক খাতে রপ্তানি আয় হয়েছে ২ হাজার ৮৮৪ দশমিক ৩৮ মিলিয়ন ডলারের। এ খাতে গত বছরের তুলনায় আয় বেড়েছে ৩৫ দশমিক ৮৩ শতাংশ। নিটওয়্যার খাতে জুলাই-নভেম্বরে রপ্তানি আয় হয়েছে ৩ হাজার ৫৩২ দশমিক ৯৭ মিলিয়ন ডলার। এ খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩৬ দশমিক ৯০ শতাংশ।

চামড়া খাতে এ সময়ে রপ্তানি আয়ের পরিমাণ ১০৯ দশমিক ৮৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। প্রবৃদব্দির হার ২৯ দশমিক ৯৮ শতাংশ। হিমায়িত খাদ্যে জুলাই-নভেম্বরে রপ্তানি আয় হয়েছে ২৬৬ দশমিক ২১ মিলিয়ন ডলার। প্রবৃদ্ধির হার ৪০ দশমিক ৩০ ভাগ।

তবে রপ্তানি আয় কমে গেছে, ওষুধ খাতে, কাঠ ও কাঠজাতীয় পণ্যে, কসমেটিক্স, রাসায়নিক সার, সিমেন্ট, চা, ফার্নিচার, কাচ ও কাচ সামগ্রী ইত্যাদি পণ্যের। ইপিবি জানিয়েছে, চা খাতে রপ্তানি আয় গত বছরের জুলাই-নভেম্বরের তুলনায় এ বছর একই সময়ে ৭০ শতাংশ কমে গেছে। গত বছর জুলাই-নভেম্বরে আয় হয়েছিল ২ দশমিক ৭৩ মিলিয়ন ডলার। ওষুধ খাতে রপ্তানি আয় কমেছে ২ শতাংশ। জুলাই-নভেম্বরে এ খাতে রপ্তানি আয়ের পরিমাণ ১৭ দশমিক ৫১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।

ইপিবি'র দেয়া পরিসংখ্যানে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বরে রপ্তানি আয়ের টার্গেটও ছাড়িয়ে গেছে। এ সময়ে মোট রপ্টস্নানি আয়ের টার্গেট ধরা হয়েছিল ৭ হাজার ১৪২ দশমিক ৮৫ মিলিয়ন ডলার। প্রকৃত রপ্তানি আয় হয়েছে ৮ হাজার ২৭৫ দশমিক ২৯ মিলিয়ন ডলার। টার্গেটের তুলনায় আয় বেড়েছে ১৫ দশমিক ৮৫ শতাংশ।

রপ্টস্নানি খাতের সংশি্নষ্টরা মনে করছেন, বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা কেটে যাওয়ায় রপ্তানি খাতের আয় বাড়ছে। এছাড়া বাংলাদেশী পণ্যের বাজারও কিছুটা সমপ্রসারিত হয়েছে। ইউরোপ-আমেরিকার বাইরে এশিয়া ও আফ্রিকার বেশ কিছু দেশে রপ্তানি আয় বাড়ছে।
Source: Daily Ittefaq, 11th December

Some Subject (Many post in one subject):