Tuesday, January 4, 2011

গার্মেন্ট শিল্পের আকাশে কালো মেঘ শ্রমিক অসন-োষ, কারখানা ভাংচুর, আগুন

গার্মেন্ট শিল্পের আকাশে কালো মেঘ শ্রমিক অসন-োষ, কারখানা ভাংচুর, আগুন

আরএইচ কৌশিক


এখন পর্যন- আমাদের রপ্তানির এককভাবে বড় সাফল্য মূলত পোশাক খাতই। অর্থনীতি এখন যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, তাতে বড় সম্ভাবনার ক্ষেত্র অনেকখানি তৈরিই হয়ে আছে। সামাজিক খাতের সূচকগুলোতে আমরা সমপর্যায়ের অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি এগিয়েছি। বলা যায়, এসব সম্ভাবনা নিয়েই হাজির হয়েছে বাংলাদেশের দুয়ারে এ গার্মেন্ট শিল্পের জন্যই। কিন্তু গার্মেন্ট কারখানায় শ্রমিক অসন-োষ, ভাঙচুরসহ আগুন লাগার ঘটনা এ খাতের উদ্যোক্তাসহ সচেতন সবাইকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। নৈরাজ্যকর এসব ঘটনার সঠিক কোনো প্রতিকার হচ্ছে না। এসব কারণে সম্ভাবনার এ খাতের ভবিষ্যৎ কোথায় গিয়ে ঠেকবে সেটিই এখন প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে।

স্বাধীনতার পর দেশে দ্রুত বিকাশমান শিল্পের মধ্যে গার্মেন্ট অন্যতম। ১৯৭৮ সালে ৮ লাখ টাকা দিয়ে যাত্রা শুরু হওয়া বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের রফতানি বর্তমানে ৯০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। বর্তমানে দেশে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার গার্মেন্ট কারখানা রয়েছে। এসব কারখানায় প্রত্যক্ষভাবে ৪০ লাখ লোক কাজ করছেন। পরোক্ষভাবে কাজ করছেন এমন সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। তিলে তিলে গড়ে ওঠা এ শিল্প খাত জিডিপিতে ১৪ শতাংশ অবদান রাখছে। আমাদের জাতীয় রফতানি আয়ের সিংহভাগই আসে এ খাত থেকে। গত বছর বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ৫ হাজার ৫৬৯ কোটি টাকা মুনাফার ৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকাই এ খাতের অবদান।

বিজিএমইএ'র তথ্যমতে, ১৯৮৩-৮৪ অর্থবছরে পোশাক খাতের রফতানি আয় ছিল ৩১ দশমিক ৫৭ মিলিয়ন ডলার, যা মোট রফতানি আয়ের মাত্র ৩ দশমিক ৮৯ শতাংশ। ১৯৮৬-৮৭ অর্থবছরে এ খাতের রফতানি আয় বেড়ে হয় ২৯৮ দশমিক ৬৭ মিলিয়ন ডলার, যা তখনকার দেশের মোট রফতানি আয়ের ২৭ দশমিক ৭৪ শতাংশ। গত অর্থবছরে (২০০৯-১০) এ খাতের রফতানি আয় ১২ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলার হতে পারে বলে ধারণা করা যাচ্ছে, যা হবে মোট রফতানি আয়ের ৭৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ।

বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা কেটে যাওয়ার পর ক্রমেই বাড়ছিল রফতানি আয়। তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন বাজার। তবে সামপ্রতিক সময়ে বড় ধাক্কা খেয়েছে দেশের পোশাক খাত। রফতানি অর্ডার পাওয়া গেলেও গ্যাস-বিদু্যৎ সংকট ও শ্রমিক অসন-োষের কারণে সেগুলো ধরা যাচ্ছে না। রফতানি উন্নয়ন বু্যরো (ইপিবি) থেকে জানা গেছে, ২০০৯-১০ মোট রফতানির লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে ৭৯ দশমিক ৪৬ ভাগই ধরা হয়েছে পোশাক খাত থেকে। এর মধ্যে ওভেন গার্মেন্টের জন্য টার্গেট ধরা হয়েছে ৬৬৮ কোটি ৭৯ লাখ ২০ হাজার ডলার। এক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ১৩ শতাংশ। নিটওয়্যার রফতানিতে টার্গেট ধরা হয়েছে ৭২৯ কোটি ৭২ লাখ ১০ হাজার ডলারের। প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ১৩ দশমিক ৫ শতাংশ।

পোশাক শিল্পের আন-র্জাতিক অঙ্গনের বড় বড় যেসব কোম্পানি এতদিন অন্যদেশে তাদের অফিস বা অন্য কোনো ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে (বায়িং হাউস) বাংলাদেশ থেকে পণ্য কিনত, তারাও এখন সরাসরি এখানে আসছে। এতে করে বাংলাদেশ পোশাক বিক্রি করে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ বেশি মূল্য পাবে বলে মনে করছে এ খাতের উদ্যোক্তারা। পাশাপাশি উচ্চমূল্যের ও মানসম্পন্ন তৈরি পোশাক রপ্তানির বিপুল সম্ভাবনাও তৈরি হয়েছে বাংলাদেশের। খুবই মানসম্পন্ন কাপড় কিনে বিক্রি করে জার্মানির অ্যাডি বায়ার, এস অলিভার, স্পিরিট, আমেরিকার ডিকেএনওয়াই, কোল, টমি হিল ফিগার। অ্যাডি বায়ার শ্রীলঙ্কা থেকে চলে এসেছে বাংলাদেশে। কাজ দিয়েছে দেশের অন্যতম একটি পোশাক শিল্পকে। ইউরোপ ও আমেরিকার বাইরে জাপানেও বাংলাদেশের বড় বাজার তৈরির বেশ সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। আমরা দেখেছি বারবার একইভাবে সাবধানতার কথা, যথাযথ নিরাপত্তার কথা, প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর কথা, শ্রমিকের জানমালের নিরাপত্তার কথা বলা হলেও তার কোনো কিছুই বাস-বায়ন হয়নি। কিছু উদ্যোগ নেয়া হলেও তা কার্যকর হয়নি। আমাদের জাতীর স্বভাবসুলভ চরিত্র হিসেবেই ঘটনা ঘটার সপ্তাহ খানিক উচ্চবাচ্য করলেও পরে তা বেমালুম ভুলে যাই। শ্রমিক অস্থিরতা ভাঙচুরের পাশাপাশি আগুন লাগাটা এখন এ খাতে ভয়াবহ আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন গার্মেন্টে অগি্নকাণ্ডের পর হতাহতের ঘটনা তদন-ে গঠিত কমিটির প্রতিবেদনগুলোতে আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনে কারখানা তৈরি করা, দুর্ঘটনার সময় জরুরি অবতরণের জন্য পর্যাপ্ত বিকল্প সিঁড়ি না রাখা, সিঁড়ির মুখে লোহার গেটে তালা লাগানো থাকায় অগি্নকাণ্ডের সময় শ্রমিকরা বের হতে না পারা এবং বস-া, পোশাক ও আবর্জনা রেখে সিঁড়ির প্রবেশপথ বন্ধ করে রাখা ও অগি্ননির্বাপণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকাকে কারণ হিসেবে তুলে ধরা হয়। এছাড়া কারখানায় দরজা খোলা রাখার ব্যাপারে সরকার, বায়ার এবং বিভিন্ন তদন-কারী দলের পক্ষে বারবার সাবধান করার পরও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। এ শিল্পের সাথে জড়িতরা বলছেন, সামান্য কিছু সুতা-বোতাম চুরি ভয়ে কারখানার সব দরজা শেকল দিয়ে তালা মারা থাকে। দুর্ঘটনার সময় সেই তালার চাবিধারী দারোয়ান পালিয়ে যায়, ফলে আগুন লাগলে বা অন্য কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে জীবন বাঁচানোর জন্য শ্রমিকরা কারখানা থেকে বের হতে পারে না। এক ফ্লোর থেকে অন্য ফ্লোরে যাওয়ার গেটও থাকে বন্ধ। অনেক ভবনের বাইরে দিয়ে ফায়ার স্কেপ সিঁড়ি থাকে না। মানবিক বিষয়কে উপেক্ষা করে শুধু ব্যবসায়িক বিষয় চিন-া করা হয়। যা শুনলে যে কারো গা শিউরে উঠবে। আগুন লাগার কারণ হিসেবে অনেকেই এমন প্রমাণ পেয়েছেন যে, ইন্সু্যরেন্স ক্লেইম, স্টক লট ক্লিয়ারসহ আরো ৩-৪ ধরনের কার্যকারণে এ আগুন লাগে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত এবং গার্মেন্ট মালিক ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ'র দেয়া তথ্যে জানা গেছে, ১৯৯০ সাল থেকে এ শিল্পে আগুনে ৭০০ বেশি শ্রমিকের মৃতু্য হয়েছে। ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা যায়, ২০০৯ সালে ঢাকাসহ সারাদেশে ১২ হাজার ১৮২টি অগি্নকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে শুধু গার্মেন্ট শিল্পেই ২৯৩টি অগি্নকাণ্ড ঘটে। সরকারি হিসাবে এতে ক্ষতির পরিমাণ ছিল ৯৯ কোটি টাকা। আর ২০০৮ থেকে ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন- মোট অগি্নকাণ্ড ঘটে ১৪ হাজার ৫৫৩টি, আগুনে পুড়ে মারা যায় ৪১৬ জন, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৬০০ কোটি টাকা। বেসরকারি আরেক হিসাবে বলা হয়, ২০ বছরে গার্মেন্ট শিল্পে অগি্নকাণ্ডে ৫০০ শ্রমিক মারা গেছে। ১৯৯০ সালে দেশে প্রথমবার মিরপুরে গার্মেন্টস শিল্পে অগি্নকাণ্ড ঘটে। এতে পুড়ে মারা যায় ৩২ জন। সেই থেকে শুরু করে একের পর এক অগি্নকাণ্ডের ঘটনা ঘটে যাচ্ছে।
Source: Daily Ittefaq, 25 dec-2010


Some Subject (Many post in one subject):

No comments:

Post a Comment