Monday, January 14, 2013

মিনি গার্মেন্টস: ফেলনা কাপড়ে পোশাক তৈরি

মিনি গার্মেন্টস: ফেলনা কাপড়ে পোশাক তৈরি


গার্মেন্টসের ফেলে দেয়া টুকরো কাপড় (ঝুট) ফেলনা নয়। টুকরো কাপড় দিয়ে তৈরি করা যায় রকমারি পোশাক। ফলে দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে মিনি গার্মেন্টস। ছোট ছোট এসব কারখানায় মূলতঃ শিশুদের পোশাকই তৈরি করা হয়।
লালমনিরহাটেও এমন একটি কারখানা গড়ে উঠেছে যেখানে শুধু শিশুদের পোশাকই নয়, তৈরি করা হচ্ছে এক ধরণের কম্বল, যা শীতকালে স্বল্প আয়ের মানুষদের ভরসা হয়ে উঠেছে। আর এ কারখানায় কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে বেশ কিছু অসহায় দরিদ্র নারীর।
লালমনিরহাটের পৌর মার্কেটে যিনি এ অঞ্চলের প্রথম ও একমাত্র মিনি গার্মেন্টসটি গড়ে তুলেছেন তার নাম আতাউর রহমান। তার পেশাগত জীবন কেটেছে উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে । তবে বর্তমানে যা করছেন তাতেই তিনি স্থিতি হতে চান। সেই সঙ্গে দরিদ্র মানুষের কর্মসংস্থানে সহায়তা প্রদান ও স্বল্প আয়ের মানুষদের মধ্যে কম মূল্যে কম্বল ও শিশুদের পোশাক সরবরাহ করে তৃপ্তি পেতে চান।
আতাউর রহমান জানান, তিনি লালমনিরহাট শহরের জনপ্রিয় একটি টেইলারিং শপে প্রায় এক যুগ কাজ করে উন্নত জীবিকা ও ভাগ্য অন্বেষণে ঢাকায় চলে নিয়েছিলেন। ঢাকায় তিনি ম্যানুয়েল মেশিন দিয়ে এমব্রয়ডারি মাস্টার হিসেবে কাজ করেছেন প্রায় ২০ বছর। শুরুতে বেশ ভালো করলেও মাঝপথে থমকে যেতে হয় তাকে। গার্মেন্টস সেক্টরে প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে ম্যানুয়েল মেশিনের কাজের চাহিদা কমে যায়। ফলে তার ১২টি এমব্রয়ডারি মেশিন থাকা সত্ত্বেও
সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারেননি। কম্পিউটারচালিত এমব্রয়ডারি মেশিন কিনতে যে প্রচুর টাকার প্রয়োজন তাও সংগ্রহ করতে পারছিলেন না। ফলে এ কাজে নিজেকে যোগ্য হিসেবে গড়ে তুলতে ও খাপ খাওয়াতে না পেরে তিনি ঢাকা ত্যাগ করতে বাধ্য হন।
তবে দমে যাননি আতাউর বললেন, নিজের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে নতুনভাবে যাত্রা শুরু করি। লালমনিরহাটে কোন গার্মেন্টস না থাকায় আমার ১২টি মেশিন দিয়েই ছোটখাট একটা কারখানা গড়ে তুলি।
আতাউর তার প্রতিষ্ঠানের নাম দিয়েছেন ‘মাস্টার বুটিক এন্ড এমব্রয়ডারি সেন্টার’। এখানে বর্তমানে ১১ জন দুস্থ নারী শ্রমিক কাজ করছেন।
কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, নানা রংয়ের টুকরো কাপড় জোড়া লাগিয়ে তৈরি করা হচ্ছে শিশুদের জামা, পায়জামাসহ নানা ধরণের পোশাক। তৈরি হওয়ার পর বুঝাই যায় না, রঙ্গিন পোশাকটি গার্মেন্টসের ফেলে দেয়া ছাঁট কাপড় (টুকরো) দিয়ে তৈরি। অন্যদিকে দেখা গেল কম্বল তৈরি হচ্ছে। টুকরো কাপড়ে কম্বল বানানো হলেও তা বুঝার উপায় নেই।
জানা গেছে, এসব টুকরো কাপড় ঢাকা থেকে কেজি হিসেবে কিনে নিয়ে আসা হয়। প্রতি কেজির দাম দুইশ’ থেকে আড়াইশ’ টাকা। এ ছাড়া দোকানে বিক্রির পর থান কাপড়ের পরিত্যক্ত অংশও কিনে আনা হয় পোশাক বা কম্বলে ব্যবহারের জন্য।
এই মিনি গার্মেন্টসের মালিক মো. আতাউর আরো বলেন, এ কাজটি আমি শুধু ব্যবসার জন্যই করছি না। ফেলে দেয়া ঝুট কাপড় থেকে পোশাক বা কম্বল তৈরিতে একটা আনন্দও আছে। আর আমি এসব বিক্রি করছি কমদামে স্বল্প আয়ের মানুষের কাছে। দরিদ্র শিশুরা রঙ্গিন পোশাক পেয়ে আনন্দ পায়। এ ছাড়া এখানে আমি ১১ জন দুস্থ নারীকে কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিতে পেরেছি। আর এখানকার তৈরি পোশাক ফেরিওয়ালারা কিনে নিয়ে হাট-বাজারে বিক্রি করে আয়-উপার্জনের সুযোগ পাচ্ছে।
এদিকে অল্প দামে এখানকার কম্বল পেয়ে স্বল্প আয়ের মানুষজনও খুশি। এ ধরণের কম্বলের বেশ চাহিদাও রয়েছে। বিশেষ করে শীতার্ত দরিদ্র মানুষেরা এ কম্বল ব্যবহার করে শীত নিবারণের চেষ্টা করেন। এখানকার একজন শ্রমিক জানান, এবারের শীতে ব্যক্তিগতভাবে ত্রাণ হিসেবে দেয়ার জন্য অনেকেই এখান থেকে কম্বল নিয়ে গেছেন।

Friday, January 4, 2013

জয়পুরহাটের উদ্যমী নারী সেলিনা আকতার জিরো থেকে লাখপতি

জয়পুরহাটের উদ্যমী নারী সেলিনা আকতার জিরো থেকে লাখপতি

















জয়পুরহাট প্রতিনিধি :
১৪ বছর আগের কথা। জয়পুরহাট শহরের শান্তিনগর মহল্লার বাসিন্দা সেলিনা আক্তার, স্বামী মোশাররফ হোসেন। ৯ বছর ও ১ বছর বয়সের দুই পুত্র সন্তান নিয়ে তাদের সংসার। স্বামী দর্জির কাজ করতো। রেলওয়ে হকার্স মার্কেটে ছোট একটি দোকান মোশাররফের। রেললাইনের উপর গড়ে ওঠা পুরাতন কাপড়ের দোকান থেকে শার্ট-প্যান্ট ও শীতের কাপড় কিনে মানুষ তার কাছ থেকে কেটে ছেটে ফিটিং করে নিত। যা আয় হতো তা দিয়ে খেয়ে না খেয়ে চলতো তাদের সংসার। সন্তানরাও প্রায়ই থাকে অভুক্ত। অভাবের এই সংসারে স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে প্রায়ই ঝগড়াঝাটি লেগেই থাকতো। এরই মধ্যে ১৪ বছর আগে আগুন লেগে পুড়ে যায় জয়পুরহাট হকার্স মার্কেটের অধিকাংশ দোকানপাট। তারটিও রক্ষা পায়নি। তার সর্বস্ব পুড়ে যায়। রক্ষা পায়নি তার সেই সেলাই মেশিনটিও। সর্বস্ব হারিয়ে গোটা পরিবার তখন দিশেহারা। এনজিও জাকস ফাউন্ডেশন ইতিমধ্যে শান্তি নগর এলাকায় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ে ঋণ দিতে শুরু করেছে। এটা ১৪ বছর আগের কথা। জাকসের সিনিয়র ঋণ কর্মকর্তা মাসুদা খানম। তখন তিনি ওই ঋণ কর্মকর্তাকে তার দুঃখের সব কথা খুলে বলেন। কিছুদিনের মধ্যে মাসুদা সেলিনার নামে বিশ হাজার টাকার ঋণের ব্যবস্থা করে দেন। সেই টাকা দিয়ে সেলিনা ২টি সেলাই মেশিন কিনে। আর স্বামী মোশাররফকে সঙ্গে নিয়ে ১০ হাজার টাকার গার্মেন্টসের কাটপিস কিনে আনেন সৈয়দপুর থেকে। স্বামী-স্ত্রী মিলে দু'জনে নব উদ্যমে দিনরাত কঠোর পরিশ্রম করে ট্রাউজার তৈরির কাজ শুরু করে। প্রতিদিন তারা দু'জনে ১০০ পিস ট্রাউজার তৈরি করে। আর সেই ট্রাউজারগুলো জয়পুরহাটের মার্কেটে পাইকারি বেচা শুরু করে। তাদের নিপুণ হাতের তৈরি ট্রাউজার বাজারে কদর বাড়তে থাকে। প্রতিদিন তা থেকে তাদের আয় হয় প্রায় ১ হাজার টাকা থেকে ১ হাজার দুইশ টাকা। মালের চাহিদা বেড়ে যায়। তখন তারা প্রতিবেশী হতদরিদ্র ৫জন মহিলাকে কাপড় সেলাইয়ের প্রশিক্ষণ দেন। তখন সেলিনা ও তার স্বামী মোশাররফ শুধু কাপড় কাটে আর ওই ৫জন নারী ট্রাউজার সেলাই করে। এভাবে তাদের কাজের পরিধি বাড়তে থাকে। এক বছরের মধ্যে ঋণের ওই টাকা পরিশোধ করে তারা জাকস ফাউন্ডেশন থেকে অরো ৫০ হাজার টাকা ঋণ নেয়। সেই টাকা দিয়ে ১০ জন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নারীদের ১০টি সেলাই মেশিন কিনে দেয়। এভাবে বাড়তে থাকে তাদের ব্যবসার আরো পরিধি। তার প্রতিষ্ঠানের নাম দেয় সৈকত গার্মেন্টস।
এখন তাদের গার্মেন্টসে মোট ৪৫ জন শ্রমিক কাজ করে। এদের মধে ৪১জনই নারী ও ৪জন পুরুষ শ্রমিক। ৪১জন প্রশিক্ষিত নারী শ্রমিক ট্রাউজার শেলাইয়ের কাজ করে। আর ৪জন পুরুষ শ্রমিক কাপড় কাটার কাজ করে। বাকি ৩১জন নারী শ্রমিককে জাকস ফাউন্ডেশন সেলাই মেশিন কেনার জন্য ঋণ দেয়। এই ৪১ জন নারী শ্রমিকের প্রত্যেকের বাড়িতেই এখন সেলাই মেশিন রয়েছে। 
সেলিনা আক্তার জানান, তার নামে এখন জাকস তাকে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা ঋণ দিয়েছে। তার ক্যাশ প্রায় সাত লাখ টাকা। তাদের ট্রাউজার এখন জয়পুরহাট, নওগাঁ, বগুড়া, গাইবান্ধা, দিনাজপুর, রংপুর, ঢাকা, সিলেট, চিটাগাংসহ দেশের প্রায় সব জায়গাতেই যায়। সেলিনার স্বামী এখন শুধু মার্কেটিং করে। আর সেলিনা তার প্রতিষ্ঠান দেখাশোনা করে। আর তার বড় ছেলে বাবা ও মার কাজে সাহায্য করে। তাদের দেখাদেখি ওই এলাকায় এখন এরূপ ৮টি মিনি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি তৈরি হয়েছে। ওই এলাকার অধিকাংশ বাড়িতেই এখন সেলাই মেশিন রয়েছে। তারা ট্রাউজার সেলাই করে এখন স্বাবলম্বী। তাদের এখন আর অভাব নাই। সেলিনা আকতারের পাশের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় সিমা বেগম (৪০) ও তার দুই মেয়ে প্রীতি পারভীন (১৮) ও চৈতি আকতার (১৬) তিনটি মেশিনে তারা ট্রাউজার সেলাইয়ে ব্যস্ত। মা সিমা বেগম জানায়, তার স্বামী অসুস্থ, শয্যাশায়ী। কোন কাজ করতে পারে না। তাই তাদের খুব অভাবের মধ্যে দিন কেটেছে। সেলাইয়ের কাজ শিখে তিনি সাংসারিক কাজের পাশাপাশি ও তার দুই মেয়ে লেখাপড়ার ফাঁকে ফাঁকে ট্রাউজার সেলাইয়ের কাজ শুরু করে। এখন প্রতিদিন তারা তিনজন মিলে ৫০ থেকে ৬০টি ট্রাউজার সেলাই করতে পারে। প্রতিটি ট্রাউজার শেলাই বাবদ তারা ৭ টাকা করে মজুরি পায়। এ থেকে তাদের প্রতিদিন ৩৫০ টাকা থেকে ৪২০ টাকা আয় হয়। এতে করে তাদের লেখাপড়া খরচ ও সংসার ভালভাবেই চলে। এভাবে ওই এলাকার সবাই এখন স্বাবলম্বী। 
জাকসের কো-অর্ডিনেটর মাইক্রো ফাইন্যান্স আফতাব আলী জানান, ওই এলাকায় সেলাই কজের জন্য তারা প্রায় দেড় শত পরিবারের মধ্যে ১ কোটি ১৯ লাখ ৫১ হাজার টাকা ঋণ সহায়তা প্রদান করেছে। যারা ঋণ নিয়েছেন তাদের প্রায় সবাই এখন স্বাবলম্বী। তারা নিয়মিত ঋণ নেয় ও সময়মত তা পরিশোধও করেন। শান্তিনগরের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও জেলা মৎস্য সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন জানান, এক সময় ওই এলাকার অধিকাংশই ছিল হতদরিদ্র। কিন্তু জাকস ফাউন্ডেশনের ঋণের টাকায় এখন ঘরে ঘরে সেলাই মেশিন আর ট্রাউজার সেলাই করে এই এলাকার নারীরা এখন স্বাবলম্বী। ওই এলাকা এখন জয়পুরহাটের মডেল। একজন উদ্যমী নারী সেলিনা আকতার পাল্টে দিয়েছে ওই এলাকার চিত্র। নিজে স্বাবলম্বী হয়েছেন অন্যদেরও করেছেন স্বাবলম্বী। পাশাপাশি ওই এলাকাকে করেছেন আলোকিত।