Wednesday, November 26, 2014

বুড়িগঙ্গা পাড়ে পোশাক বিপ্লব, রোজ বিক্রি ৫০ কোটি টাকা!

বুড়িগঙ্গা পাড়ে পোশাক বিপ্লব, রোজ বিক্রি ৫০ কোটি টাকা!

আগানগর-শুভাঢ্যা (কেরানীগঞ্জ) থেকে ফিরে: রাজধানী ঢাকার দক্ষিণে বুড়িগঙ্গার ওপাড়ে কেরাণীগঞ্জ উপজেলার আগানগর ও শুভাঢ্যা ইউনিয়ন। আগানগরের ঠিক পশ্চিমেই বাংলার জাপানখ্যাত জিনজিরা, মুঘল আমলের স্মৃতিধন্য ভগ্নপ্রায় জিঞ্জিরা প্রাসাদ। এসব স্থানের ঐতিহাসিক পরিচিতি কালের বিবর্তনে চাপা পড়ে গেলেও বিভিন্ন শিল্পের প্রভূত উন্নয়নে এখন জেগে উঠছে আবার।
হাল আমলে ঢাকা জেলার অন্তর্গত কেরাণীগঞ্জ উপজেলার বুড়িগঙ্গা ঘেঁষা আগানগর ও শুভাঢ্যায় গড়ে উঠা ক্ষুদ্র গার্মেন্টসপল্লী ঘিরে তৈরি হয়েছে অপার সম্ভাবনা। স্বাধীনতার পর সীমিত পরিসরে শুরু হওয়া এই গার্মেন্টসপল্লী ধীরে ধীরে ব্যাপকতা পেয়ে বেশ জাঁকিয়ে বসেছে এখন।
বর্তমানে আগানগর-শুভাঢ্যা গার্মেন্টস পল্লীতে ১০ হাজারেরও বেশি ক্ষুদ্র তৈরি পোশাক কারখানা দেশের অভ্যন্তরীণ পোশাকের প্রায় ৬০ ভাগ চাহিদা মেটাচ্ছে। কেরাণীগঞ্জ গার্মেন্টস ব্যবসায়ী ও দোকান মালিক সমিতির তথ্যমতে, এখানে দিনে বিক্রি হচ্ছে কমপক্ষে ৫০ কোটি টাকার বিভিন্ন পোশাক।
মফস্বল শহরগুলোর বিপণিবিতান তো বটেই, রাজধানীর অভিজাত শপিংমলগুলোতেও এখন বিদেশি কাপড়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ক্রেতাদের হাতে হ‍াতে উঠছে এখানকার পোশাক। এমনকি রপ্তানি হচ্ছে মালয়েশিয়া, ভারত, বার্মা, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে।
দেশের সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে এটি অত্যন্ত সুখের খবর হলেও এ ক্ষুদ্র গার্মেন্টসপল্লীর বিকাশে উল্লেখযোগ্য কোন সহযোগিতা নেই সরকারি বা বেসরকারি তরফে। এখানকার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা স্ব-প্রচেষ্টায় বিভিন্ন প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে এগিয়ে নিচ্ছেন সম্ভাবনাময় এই শিল্প।
সম্প্রতি আগানগর-শুভাঢ্যা গার্মেন্টসপল্লী ঘুরে এসব তথ্য জানা গেছে।
পাঞ্জাবি, শার্ট, ফতোয়া, স্যুট-ব্লেজারসহ সব রকমের শীতবস্ত্র, শিশুদের কাপড় থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রকারের গার্মেন্টস আইটেম পাওয়া গেলেও এই ক্ষুদ্র গার্মেন্টসপল্লী বিশেষভাবে বিখ্যাত জিন্স ও গেভাডিন প্যান্টের জন্য।
চীন, জাপান, থাইল্যান্ড, ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নামিদামি ব্রান্ডের জিন্স ও গেভাডিন প্যান্টের আদলে হুবুহু প্রস্তুতকৃত এখানকার প্যান্ট বিদেশি প্যান্ট হিসেবে দেশের খ্যাতনামা শপিংমলে বিক্রি হচ্ছে দেদারছে। মফস্বলের বিপণী বিতানগুলোতেও মেলা কদর এর।
এক্সপোর্ট গার্মেন্টের ফেব্রিক্স কিনে আগানগর-শুভাড্যা ক্ষুদ্র গার্মেন্টসপল্লীর কারিগরেরা নিজস্ব আদলে তৈরি করছেন এসব প্যান্ট। এসব ব্যবসায়ীর একটি অংশ আবার বড় তৈরি পোশাক কারখানার আংশিক ত্রুটিযুক্ত কাপড় বা ঝুট সংগ্রহ করে তৈরি করছেন চমৎকার জিন্স প্যান্ট।
প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এ পল্লীতে প্রায় ৫-৭ লাখ মানুষ সম্পৃক্ত রয়েছে। কাকডকা ভোরেই আগানগরের নাগরমহল রোড ও শুভাঢ্যার বাঘাবাড়ি রোডের ব্যস্ততা বেড়ে যায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কাপড় কিনতে আসা ব্যবসায়ীদের পদচারণায়। ভাঙ্গাচোরা রাস্তার কারণে প্রতিনিয়তই যানজট লেগেই থাকে। বুড়িগঙ্গার তীর ঘেঁষেও থাকে অসংখ্য নৌকার ভিঁড়। সকাল থেকে রাত অবধি চলে পোশাকের বিকিকিনি। কাপড় কাটা, ওয়াশিং, সেলাইসহ প্রস্তুত প্রণালীর বিভিন্ন কাজে দিনরাত ব্যস্ত থাকেন এ পল্লীর শ্রমিক ও তাদের ক্ষুদ্র মালিকরা। পল্লীর ভেতরের রাস্তাগুলোতে হাঁটলেই যেতে চোখে পড়বে প্যান্ট ও অন্যান্য কাপড়ের বড় বড় বোঝা মাথায় নিয়ে শ্রমিকদের কর্মময় পদচারণা।
প্রাপ্ততথ্য মতে, দেশের বৃহৎ তৈরি পোশাক কারখানাগুলোর মতো এখানে শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনা খুব একটা ঘটে না। ক্ষুদ্র পুঁজির ব্যবসায়ীরা সারাক্ষণ কারখানা শ্রমিকদের সঙ্গেই লেগে থাকেন দ্রুত কাজ শেষ করার অভিপ্রায়ে।
আগানগরের নাগরমহল রোডের কলোনি মার্কেটের আমিনুল গার্মেন্টসের মালিক মন্টু শেখ(৫২)।  মুন্সিগঞ্জ জেলার লৌহগঞ্জ থানার খেতেরপাড়া গ্রামের বাসিন্দা এই ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী এর আগে জাপানে কাটিয়ে এসেছেন অনেক দিন। দেশে ফিরে কিছুদিন করেছেন কাঠের ব্যবসা। ২০০০ সাল থেকে আগানগরে এসে শুরু করেন ঝুট কাপড় দিয়ে জিন্স তৈরির ব্যবসা।
মন্টু শেখ বাংলানিউজকে বলেন, ‘‘সাভার ইপিজেড, গাজীপুর, টংগী, নারায়ণগঞ্জ শিল্পাঞ্চল থেকে জিন্সের ঝুট ফেব্রিক্স স্থানীয় সরবরাহকারীদের কাছ থেকে ৫/৭ হাজার টাকা মণে সংগ্রহ করে সেগুলোকে প্রথমে সাইজ, মান ও কালার অনুযায়ি পৃথক করি। এরপর সেগুলোকে কাটিং করি। তারপর বিদেশি প্যান্টের আদলে কম্পিউটারাইডজ মেশিনে এমব্রয়ডারি করে দক্ষ দর্জি দিয়ে সেলাই করা হয়। সেলাই ও এমব্রয়ডারির পর সেগুলোকে ওয়াশিং মেশিনে কালার কিংবা বিশেষ অংশে ভিন্ন রূপদান করা হয়’’।
তিনি বলেন, ‘‘এবারের ঈদ সামনে রেখে শবে কদরের পর থেকেই ঈদ পোশাক তৈরির কাজ শুরু হয়ে যায়। এবারের ঈদে ব্যতিক্রম হলো- ছেলেদের প্যান্টের চেয়ে লেডিস প্যান্টের চাহিদা অনেক বেশি। শিশুদের থেকে বড় সবার জন্যই এই লেডিস প্যান্টের চাহিদা রয়েছে। উপমহাদেশে আগে ভারতেই এই লেডিস প্যান্টের চাহিদা বেশি ছিল। ধীরে ধীরে বাংলাদেশেও এই চাহিদা বেড়েছে।’’
মন্টু শেখ আরও বলেন, ‘‘রমজানের আগে ১৫ হাজার প্যান্টের স্টক ছিল। ঈদ সামনে রেখে আরও ১০ হাজার প্যান্টের প্রোডাকশন চলমান রয়েছে। আমরা সবই পাইকারি বিক্রি করি। আমাদের তৈরি প্যান্ট ১৬০ টাকা থেকে ৩০০ টাকার মধ্যে পাওয়া যাবে।’’
বিদ্যুত স্বল্পতা এই ক্ষুদ্র গার্মেন্টসপল্লীর বিকাশে সবচে’ বড় প্রতিবন্ধক হিসেবে উল্লেখ করে আগানগর-শুভাড্যার ক্ষুদ্র গার্মেন্টস ব্যবসায়ীরা জানান, পুরো গার্মেন্টসপল্লীতে ৩৭ মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা থাকলেও পাওয়া যাচ্ছে মাত্র ৭/৮ মেগাওয়াট। দিনের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বিদ্যুৎ থাকে মাত্র ৩/৪  ঘণ্টা।  এখানকার একজন ব্যবসায়ীকে যদি বিদ্যুৎ বিল দিতে হয় ৩ হাজার টাকা, তাহলে তাকে জেনারেটর বিল দিতে হয় কমপক্ষে ১৫ হাজার টাকা। জেনারেটরে একটি ফ্যানের জন্য ৬০০ টাকা, লাইট ৬০০ টাকা, সেলাই মোটর ১২শ’ টাকা, আয়রণ মেশিনের জন্য ৫ হাজার টাকা বিল দিতে হয়।
ব্যবসায়ীরা জানান, অনেক সময় কাপড় অর্ধেক ওয়াশ করার পর বিদ্যুত চলে গেলে ওই কাপড়েরর বাকি অংশ ওয়াশ করতে না পারায় রঙ নষ্ট হয়ে যায়। ফলে সেসব কাপড় বিক্রির অযোগ্য হয়ে পড়ে।
শুভাঢ্যার শহীদ দেলোয়ার হোসেন রোডের জেলা পরিষদ মার্কেটের নিউ জিতু গার্মেন্টসের মালিক শেখ জানে আলম বাংলানিউজকে বলেন, ‘‘আগের বছরগুলোতে বিদেশি কাপড় বিক্রি বেশি হলেও এবার এখানকার কাপড়ের মান ভাল হওয়ায় দেশি কাপড়ের প্রচুর চাহিদা তৈরি হয়েছে। আগানগর-শুভাঢ্যার নাম না বললেও রাজধানীর পলওয়েল, বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্সসহ অভিজাত বিপণী বিতানগুলোতে আমাদের তৈরি জিন্স প্যান্টসহ অন্যান্য কাপড় পাওয়া যাবে।’’
তিনি জানান, ‘‘শুধু দেশেই নয়, কোন কোন ব্যবসায়ী মালয়েশিয়া, ভারত, বার্মা, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশেও পাঠাচ্ছে আমাদের তৈরি কাপড়।’’
মুন্সিগঞ্জ জেলার লৌহজং থানার মেদেনীমন্ডল গ্রামের বাসিন্দা জিন্স প্যান্ট তৈরির কারিগর রনি বাংলানিউজকে বলেন, ‘‘এখানে যেমন রিজেক্ট মাল দিয়া প্যান্ট বানানো হয়, তেমনি ইনটেক থান দিয়েও প্যান্ট বানানো হয়। আমরা জাপান, চায়না, থাই প্যান্টের সেম্পল দেইখা তাদের মতো করে হুবুহু তৈরি করতে পারি। অনেক সময় বিদেশি প্যান্টের চেয়েও আমাদের ফিনিশিং ভাল হয়।’’
তিনি বলেন, ‘‘একটি লট সম্পূর্ণ করতে প্রায় ১৫-২০ দিন লাগে। এই গার্মেন্টসপল্লীতে এক পিস জিন্সের প্যান্টের কাপড় কাটার জন্য কাটিং মাস্টাররা প্রোডাকশন অনুসারে ৫/৬ টাকা করে পায়। অপারেটরদের বেতন মাসিক ৮/১০ হাজার টাকা, কারিগররা পান একটি প্যান্টের জন্য ৩০-৪০ টাকা আর নারীরা বোতাম লাগানো কাজের জন্য পান ৪-৬ হাজার টাকা।’’
আগানগর-শুভাঢ্যা গার্মেন্টসপল্লীর ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের সংগঠন কেরাণীগঞ্জ গার্মেন্টস ব্যবসায়ী ও দোকান মালিক সমিতি। সমিতির সাধারণ সম্পাদক মিলন হোসেন খান এ পল্লীর বিভিন্ন সম্ভাবনার কথা তুলে ধরেন বাংলানিউজের কাছে। একই সঙ্গে সরকারের কাছে সম্ভাবনাময় এই পল্লীর বিকাশে বেশ কিছু দাবি জানান তিনি।
বাংলানিউজকে মিলন হোসেন খান বলেন, ‘‘আমাদের তৈরি কাপড়ের মান দিন দিন ভাল হচ্ছে। তাই বিগত সময়ের চেয়ে চাহিদাও অনেক বেশি। আমাদের গার্মেন্টসপল্লীতে ৪/৫ লাখ শ্রমিক কাজ করে। এখানে মালিক-শ্রমিকের মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক থাকায় কোন শ্রমিক অসন্তোষ নেই। আমরা অনেক ঝুঁকি নিয়ে এ ব্যবসা করে দেশের অভ্যন্তরীণ পোশাকের ৬০/৭০ ভাগ চাহিদা মেটাচ্ছি। অনেক সময় দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ আমাদের কাছ থেকে মাল নিয়ে গিয়ে উধাও হয়ে যায়। তখন সমস্যায় পড়তে হয়।’’
তিনি বলেন, ‘‘কেরাণীগঞ্জ গার্মেন্টস ব্যবসায়ী ও দোকান মালিক সমিতির নিবন্ধিত ৫ হাজার ব্যবসায়ী রয়েছেন। নিবন্ধন ছাড়াও রয়েছেন আরও ৫ হাজার। বহু সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এই ঈদ মৌসুমে প্রতিদিন কমপক্ষে ৫০ কোটি টাকার পোশাক বিক্রি হচ্ছে এই গার্মেন্টসপল্লীতে।’’
সরকার দেশের রপ্তানিমুখী বৃহৎ গার্মেন্টসের প্রতি বেশি আন্তরিক উল্লেখ করে মিলন হোসেন খান বলেন, ‘‘দেশের অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখলেও আমাদের ক্ষুদ্র পোশাক তৈরিকারকদের দিকে সরকার নজর দিচ্ছে না। রপ্তানিমুখী বড় গার্মেন্টসের জন্য বিদেশ থেকে এক্সোসরিজ  আনতে ট্যাক্স ফ্রি সুবিধা থাকলেও আমাদের সে সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না। এ শিল্পের জন্য বিদ্যুৎ-গ্যাসের প্রয়োজন সবচে’ বেশি হলেও আমরা পাচ্ছি প্রয়োজনের তুলনায় খুবই স্বল্প। যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই খারাপ।’’
এক্সোসরিজ আনতে ট্যাক্স ফ্রি সুবিধা, বিদ্যু‍ৎ-গ্যাস সুবিধা পর্যাপ্তকরণ, সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের সহজশর্তে ঋন সুবিধা প্রদান ও যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করা হলে আগানগর-শুভাঢ্যা ক্ষুদ্র গার্মেন্টসপল্লী কেবল দেশেই নয়, গোটা এশিয়ার মধ্যে বিখ্যাত হয়ে উঠতে পারে, এমন আশাবাদ মিলন হোসেন খানের।


Related All Post:




Related Subject (Many post in one subject):

Some Bangladeshi Garments Website:


2 comments:

  1. Hi greetings!
    Thanks for sharing this.
    Daily Bangladesh is an online news portal.To get regular updates visit https://www.daily-bangladesh.com/
    Thank you.

    ReplyDelete
  2. ঢাকার বায়ুমানে উন্নতি, অবস্থান ১৩ আরো জানতে https://www.gazipurkotha.com/ঢাকার-বায়ুমানে-উন্নতি-অবস্থান-১৩/21258

    ReplyDelete